আজ ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভ করে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণা অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পাকিস্তান সরকার, প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ও বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদে বঙ্গবন্ধুকে তার স্বদেশে ফিরিয়ে দিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ১টা ৪১ মিনিটে ছাড়া পান। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে ইংরেজি হিসেবে ৮ জানুয়ারি। এদিন বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বেলা ১০টার পর থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন।
১০ তারিখ সকালেই বঙ্গবন্ধু ভারতের দিল্লিতে নামেন। সেখানে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতারা, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
আজকের এ ঘটনা ছিল বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের আরেক আশীর্বাদ এবং বিজয়গাঁথা। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে ছিল একটি বড় প্রেরণা। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ তীতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বির্জয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন
১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পরই বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়।
সেই সময়ে প্রকাশিত পত্রিকা থেকে জানা যায়, বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামলো তার দু’চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস।
জনগণ-মন-নন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তাঁর ঐতিহাসিক ধ্রুপদী বক্তৃতায় বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন, সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন।
আগামী প্রজন্মের প্রতি আমার আহবান থাকবে যারা তরুণ ও ছাত্র, যাদের উপর বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ভর করে, আপনারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের দেশের প্রতি যে আত্মত্যাগ, যে জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলের অন্ধকার প্রকষ্টে কাটিয়ে গেছেন তাঁর যে স্বপ্ন ছিল, সোনার বাংলা বিনির্মান’ তা বাস্তবায়ন করতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ ও লালন করতে হবে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অংশগ্রণের মাধ্যমে অংশধারিত্ব করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু যেভাবে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও দেশের বিরুদ্ধে অন্যায়ের সাথে কোনদিন আপোষ করেননি, দেশের মানুষের প্রতি তাঁর যে কমিটমেন্ট ও আস্থা তা থেকে সে বিন্ধু পরিমান পিছু হাটেন নি। দেশের মানুষও ভালোবাসার বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যখনই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তখন বিমানবন্দরে লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হোন এবং দেশ গড়ার জন্য দেশের মানুষই বঙ্গবন্ধুকে দায়িত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করার সূযোগ পান। তাই, দেশের জন্য কাজ করতে গেলে অনেক বাঁধা-বিপত্তি সামনে আসবে কিন্তু বুকে সাহস রেখে পিতা মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ করে পিতা মুজিবের যে স্বপ্ন, সোনার বাংলা বিনির্মাণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ও দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় তা বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
আমাদের স্বরণ রাখতে হবে, ‘বঙ্গববন্ধু মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশকে জানতে হলে, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতে হলে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হবে । পিতা মুজিব কে জানতে হলে, পিতা মুজিবের লেখা তিনটি বই- ১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ২। কারাগারের রোজনামচা ৩। আমার দেখা নয়াচীন বই গুলো পড়ার জন্য আহ্বান রইল।
আল্লাহ হাফেজ।
লেখকঃ সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।