মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) শুরুর দিকে সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে চলে যায় অক্সিজেন সেবা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। এমতাবস্থায় আশার আলো নিয়ে উপস্থিত হয় ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’। ২৫ জুন থেকে শুরু হয় তাদের এই কার্যক্রম। ১২০ দিনে এখন পর্যন্ত ২০২৫ জন মানুষের কাছে বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে উদ্যোক্তারা।

করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা বিভিন্নমূখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ঠিক সেসময় থেকেই নিরবে কাজ করেছে ছাত্রলীগ। তারা তাদের সাধ্যমত অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা মেটানোর কাজে ছিল তৎপর। অসহায় রোগীদের নিরবিচ্ছিন্ন সেবাই তাদের মানসিক অবস্থাকে দৃঢ় করেছে। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এবং ফেনীতে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া সারাদেশে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সিলিন্ডার পাঠিয়েও সেবা দেয়া হচ্ছে বিশেষ এই উদ্যোগের মাধ্যমে।

জানা গেছে ২৫ জুন থেকে ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’ কার্যক্রম শুরু হয়। এই কার্যক্রমের উদ্যোক্তা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসু’র সদ্যসাবেক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী’। তার সাথে যুক্ত আছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসু সদস্য রফিকুল ইসলাম সবুজ। বর্তমানে সারাদেশে কমপক্ষে ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।

জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার উদ্যোগ সম্পর্কে সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, “করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সব রোগীর ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় না। করোনা আক্রান্ত রোগীর এক পর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাপক সমস্যা হয়ে পড়ে আর এসময় কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। শুধু করোনা আক্রান্ত রোগী নয়, অন্যান্য রোগীর জন্যও অক্সিজেনের প্রয়োজন হতে পারে।

এমতাবস্থায় অক্সিজেন মজুত করা ও এর মূল্য বেশী হওয়ায় অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন গ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছে না। তখন মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন কি হতে পারে সেটিকে প্রাধান্য দিয়ে এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য আমরা বিনামূল্যে “জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’র” উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলাম।”

এই কার্যক্রম কতদিন চলমান থাকবে জানতে চাইলে সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা কার্যক্রমের আজ ১০২ তম দিন। একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা স্লোগানকে সামনে রেখে আমরা বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম শুরু করি। আমরা চাইনা এই অন্ধকার সময়টা আরো দীর্ঘতর হোক। যতদিন এই অন্ধকার কেটে না যাবে ততদিন আপনাদের পাশে থাকার দৃপ্ত শপথ নিয়েই আমরা এই কার্যক্রম শুরু করি এবং সেটি অব্যাহত থাকবে।

জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদ বিন কাদের বলেন, “আপনারা জানেন বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার কাজটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমরা তিনজন উদ্যোক্তার পারিবারিক আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এই কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা আর্থিক বিবরণীর সম্পূর্ণ হিসাব দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করি প্রতিমাসে একবার করে হিসাব দিয়ে যেতে।”

স্বেচ্ছাসেবকদের ধন্যবাদ জানিয়ে সাদ বিন কাদের বলেন, ” স্বেচ্ছাসেবক বন্ধুদের জন্য এই কাজটি পরিচালনায় অনেক সহজ হয়েছে আমাদের। জীবন এবং পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে তারা যেভাবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের কাছে সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন সেটির প্রশংসা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। এই কার্যক্রম পরিচালনায় যারা মানবিকতার হাত প্রশস্ত করেছেন তাদের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানাই।”

চট্টগ্রাম ইউনিটের স্বেচ্ছাসেবক সাফওয়ান চৌধুরী বলেন, “আমরা যখন অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের পৌঁছে দিই তখন তাদের মুখের হাসি আমাদেরকে অভিভূত করে। তবে সবসময়ই যে ভালো আচরণ করে এমন না; কিছু মানুষ এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ করে যেন মনে হয় আমরা তাদের কর্মচারী।”

এই সেবার মাধ্যমে উপকৃত একজন হয়েছেন দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার জয়নাল আবেদিন।তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন যে কোন সময় কমে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় হাসপাতালেও তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন সেবা মেলে না। কিন্তু জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার মাধ্যমে দিন বা রাতের যে কোন সময় এই সেবাটির নিশ্চয়তা রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী পর্যায়ে এ ধরনের সেবা সত্যিই আশাব্যাঞ্জক। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে তারা অনেকের কাছে অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দিয়েছে, যাদের এটি খুবই প্রয়োজনে এসেছে। ”

জয়নাল বলেন, “আমাদের বাসায় তিনজন করোনা রোগী। একজনের হঠাৎ অক্সিজেন স্যাচুরেশন বিপদসীমায় চলে যায়। তৎক্ষণাত বিষয়টি জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরীকে জানালে এক ঘণ্টার মধ্যে বাসায় অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার পৌঁছে যায়। এর জন্য কোনো বিনিময়ও দিতে হয়নি। হয়তো এত দ্রুত সময়ে হাসপাতালেও এ ধরনের সেবা পাওয়া যেত না। এ ধরনের সেবার মানসিকতা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম সংঘবদ্ধ হলে করোনার ক্লান্তি ভুলে মানুষ নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার সাহস পাবে।”

সাদ বিন আরও বলেন, দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশে সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা সব ধরনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে মানুষের পাশে থেকেছে। নেত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে আমরা বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি নিয়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি করোনামুক্ত যে নতুন ভোরের স্বপ্ন আমরা দেখি সে ভোর খুব বেশি দূরে নয়। দুঃখের অমানিশা ভেদ করে সুখের সোনালী সূর্য ফিরে আসবে সে প্রত্যাশায়।

অক্সিজেন কার্যক্রমের ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষমতা হারায়। তখন বাতাস থেকে পরিমাণমতো অক্সিজেন নিয়ে রক্তে দিতে পারে না।

রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্রুত অকেজো হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯৫ শতাংশ রোগীর অক্সিজেন দেওয়া দরকার।’

করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকাতেও অক্সিজেনের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিবিশেষ অসুবিধা বোধ করার আগেই শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। সুতরাং অক্সিজেনের জোর প্রস্তুতি থাকা দরকার।