আমি ডাক্তার, আমি একজন চিকিৎসা ব্যবসায়ী, কোন সেবক না। নিজের সময়, অর্থ, শ্রম, মেধা ব্যয় করে ডাক্তার হয়েছি। এগুলো হল আমার ব্যবসার বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ আমি করেছি। আমার পরিবার করেছে। কারোর পকেটের টাকায় আমার স্কুল, কলেজ, মেডিকেলের বেতন হয় নি। কেউ এসে আমার হয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে যায় নি। ডাক্তার হতে কষ্ট করতে হয়েছে। এটা ফ্রিতে হওয়া যায় না।
তাই এখন আমি রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে টাকা নিব। এটাই তো স্বাভাবিক। ফ্রি চিকিৎসা আর ভিক্ষা একই জিনিস। আমি যদি কাউকে ভিক্ষা না দিই, এতে যেমন কারোর কিছু বলার নাই, তেমনি ফ্রি চিকিৎসা না দিলেও কেউ কিছু বলার অধিকার রাখে না।
৫টি মৌলিক চাহিদা হলঃ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা।
১। দোকানে গিয়ে বলুন, ১ কেজি ফ্রি চাল দিতে। বলতে পারবেন? মনে হবে না, ভিক্ষা চাইছেন? আর চাইলেই কি তা পাবেন? কয়জন দোকানি আপনাকে ফ্রি দিবে? হয়ত কিছু কম দামে দিবে। কিন্তু কখনোই তার কেনা দামের চেয়ে কম টাকায় দিবে না।
২। একটা কাপড়ের দোকানে গিয়ে বলেন, একটা কাপড় ফ্রি দিতে। কি, নিজেকে ভিক্ষুক মনে হচ্ছে? কাপড়ের দোকানী আপনাকে তাড়িয়ে দিলে কি আপনি কিছু বলতে পারবেন?
৩। একটা বাড়িওয়ালাকে গিয়ে ১ টা ঘর চান। ১ মাস ফ্রি থাকার বায়না করুন। অথবা কোন আবাসিক হোটেলে গিয়ে ১ রাত ফ্রি থাকার কথা বলুন। সিকিউরিটি গার্ড আপনাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।
৪। কোন শিক্ষকের কাছে গিয়ে ফ্রিতে ১ মাস পড়তে চান। কতজন আপনাকে পড়াবে, তা নিশ্চয়ই খুব ভালোই বুঝতে পেরেছেন। খুব গরীব না হলে কেউ আপনাকে ফ্রিতে পড়াবে না।
৫। রইল বাকি চিকিৎসা। নিজেদের টাকা দেবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ফ্রি চিকিৎসার নামে আপনারা যেভাবে ভিক্ষা নিচ্ছেন, অথচ নিজেদের ভিক্ষুক বলে মনে করছেন না – এতে আপনাদের কি কোন বিকার নাই? আশে পাশে কেউ ডাক্তার পরিচয় পেলেই ১ ডজন সমস্যার ঝাঁপি খুলে বসেন। চিকিৎসা চান বিনামূল্যে। এই চিকিৎসা কি আমি স্বপ্নে পেয়েছি? কোন কষ্ট করতে হয় নাই এগুলো শিখতে?
অধিকাংশ চিকিৎসকই এই কথাগুলো বোঝেন না। একেকজন দয়ার সাগর মহাসাগর। কেউ এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে সমস্যা বললেই বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে দেন। বুঝতে হবে, এখন নকল ভিক্ষুক যেমন বের হয়েছে রাস্তায়, তেমনি নকল গরীব রোগীও বের হয়েছে। তাই ভিক্ষা দেবার আগে যেমন যাচাই করে দিতে হয়, ফ্রি চিকিৎসাও সবাইকে দেয়া ঠিক না।
এমন অনেক ওয়েবসাইট আছে, যেখানে মানুষ ফ্রি চিকিৎসার আবেদন করছে শয়ে শয়ে। এরা আসলে গরীব না। গরীব হলে ইন্টারনেট কিনে ওয়েবসাইটে লিখতে পারত না। আসল গরীবরা কখনো ফ্রি চিকিৎসা চায় না। তারা ১০ টাকা দিয়ে হলেও সরকারী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়।
ফ্রি চিকিৎসা যারা চায়, আমার দৃষ্টিতে তারা শুধুই ভিক্ষুক। এরা ১০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়াকে প্রেস্টিজের জন্য হানিকর ভাবে। রাস্তাঘাটে ডাক্তার দেখলেই হাত পেতে দৌড়ে আসে।
এদের চিকিৎসা না দিয়ে হাসপাতালের ঠিকানা ধরিয়ে দিন। চিকিৎসা পেশাটার ওজন বজায় রাখুন। খ্যাতি আর যশের উদ্দেশ্যে ফ্রি ক্যাম্প, ফ্রি চিকিৎসা বন্ধ না করলে মানুষ ভাববে, আমাদের ডাক্তার হতে কোন টাকা পয়সা লাগে নাই। আমরা বসে আছি মানুষকে ভিক্ষা দেবার জন্য।
করোনায় এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত ডাক্তার মারা গেলেন, অথচ আজ দেশের এক কথিত প্রথম সারির সংবাদপত্র বিভিন্ন পেশার ১২০ জনের মধ্যে একজন চিকিৎসকের নাম পর্যন্ত রাখল না। বরং খুলনায় পিটিয়ে মাথায় রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে এক চিকিৎসককে মেরে ফেলল। এতে আবার ফেসবুকে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এত কিছুর পরেও যে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিচ্ছে, তা দেশের রোগীদের সাত জনমের পুণ্যের ফল, আর দেশের ডাক্তারদের সাত জনমের পাপের ফল।
খুব করে চাই, পরের জন্মে ট্রাক ড্রাইভার হতে। একজন ট্রাক ড্রাইভার মানুষ মারলেও ফাঁসির রায় পাবার পরে সারা বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থা অচল করে দিতে পারে। আর আমাদের একের পর এক ডাক্তার খুন হলেও আমরা মুখ বুজে সেই হামলাকারীদের চিকিৎসা দিই। ট্রাক ড্রাইভারদের মধ্যে যে ইউনিটি আছে, চিকিৎসকদের মধ্যে তা নাই। ইউনিটি ছাড়া কোন পেশা টিকে থাকতে পারে না।
সেবা শব্দটা চিকিৎসা পেশার সাথে আর ব্যবহার করবেন না। সেবা পেতে হলে যোগ্যতা লাগে। সেই যোগ্যতা বাঙালীর কখনোই ছিল না, আর হবেও না।
হে চিকিৎসকগণ, সেবা করার এত ইচ্ছা থাকলে বাসায় বসে নিজের বাবা-মার পা টিপুন। কারণ, তাদের কারণেই আজ আপনি ডাক্তার। বাবা-মাকে বাসায় রেখে এসে ফ্রিতে আরেকজনের চিকিৎসা করার আগে ১০ বার ভাবুন, আপনার ভবিষ্যৎ হত্যাকারীর ফ্রি চিকিৎসা করলেন না তো?
লিখেছেনঃ ডাঃ সুজন পাল