প্রাণঘাতী করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখে থেকে লড়ছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অবজ্ঞার স্বীকার হচ্ছেন তাঁরা। তেমনই একজন করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়া ডাক্তার স্বামীর প্রতি দায়িত্বশীলদের অবহেলা নিয়ে রাগ ও ক্ষোভের কথা লিখেছেন তার স্ত্রী নাজিয়া জামান তৃষা। লিখাটি জানতার মুখের পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো।
“আমার হাজবেন্ড একজন সরকারী ডাক্তার। স্কুল কলেজে ভালো ছাত্র ছিলো। ম্যাথে তুখোড়। ইচ্ছা ছিলো ম্যাথ রিলেটেড পড়ালেখা করবে। সেইটা হয় নাই। বাপের ইচ্ছায় ডাক্তারী পড়ছে। হাতে টাকা পাইলে যদি অন্য কোন কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে যায়, সেই ভয়ে তার বাপে তারে নিজ উদ্যোগে ঢাকায় যাইয়া মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি করায়া দিছে।
আমাদের বাপ মায়েদের উপরে কোন ডিসিশান নেওয়া যায়না, এমনই মেন্টাল প্রেশার তারা ক্রিয়েট করে ফেলে। কোনদিন আমার বাপ মাকে আমি বলতে শুনি নাই, “তৃষা, তোমার যা হইতে মনে চায়, তাই হও।” বাপ মায়ের প্রত্যাশার পাহাড় কোনো কোনো শক্তিশালী বাচ্চা ঠেলতে পারে, অধিকাংশই পারেনা। তারা আমার মতো জগাখিচুড়ি হয়ে যায়, যাদের জীবনের কোনও স্টেপেই স্যাটিসফেকশনটা ঠিকঠাক আসেনা।
তো, যা বলতেসিলাম, আমার হাজবেন্ড। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে, খ্যাপ মাইরা মাইরা বিরাট অংকের টাকা জোগাড় করতে হয় তারে বিভিন্ন কোর্স (!) করে উপযুক্ত হওয়ার জন্য। তার মধ্যেই চলে এফসিপিএসের পড়ালেখা। পার্ট ওয়ান হয়ে গেলে তারে টেম্পোরারি চাকরিটা ছাড়তে হয়, পার্ট টু এর অনারারি ট্রেনিংয়ের জন্য। আর আগের চাকরির জমায় রাখা টাকা দিয়া চলতে হয়। এর মাঝে তো আবার বিসিএসও দিতে হয়।
বিসিএসের জাউরামার্কা পড়ালেখা, ট্র্যাকের সম্পূর্ণ বাইরে। ২৭তম বিসিএস, ইতিহাসের দীর্ঘতম বিসিএস পরীক্ষা৷ দুইবার করে ভাইভা। কোন রকম মামা চাচা, কোটামোটা ছাড়া এই ছেলে দুইবারই মেধাতালিকায় টিকে। প্রথমবার ৮০’র ঘরে প্লেস, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ভাইভাতে তো ৬০ এর ঘরে। ডাক্তার রাখসিলো ফার্স্ট চয়েস, নির্বোধ হইলে যা হয় আর কী!
এরপরে জয়েন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যাওয়া লাগে চাকরিটা নিয়ে। যেখানে সার্ভিস দিতে হবে ঠিকই, কিন্তু সার্ভিসটা এফসিপিএসের পার্ট টু এর ৫ বছরের ট্রেনিং হিসেবে কাউন্ট হবেনা। এই পড়া, সেই পড়া, আজ চাকরির পরীক্ষা তো কাল ডিগ্রির পরীক্ষা। এমডি রেসিডেন্সি ৫ বছর, ২০০৬ থেকে ২০২০, পাশ করার পর থেকে এমডি নেওয়া পর্যন্ত। আমি বুঝি না, ঠিক কতো বছর বয়স হইলে একটা ডাক্তার পড়ালেখা শেষ করে একটা স্থির লাইফ লিড করতে পারে?
তাও তো সে প্রতিটা পরীক্ষায় প্রথম বসায় পাশ। যদি সেইটা না হইতো? না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিলো। হয়ে গেছে, এইটা মনে হয় চরম সৌভাগ্যই বলা যায়। একজন ডাক্তারের মানসিক ক্ষত আপনারা হয়তো কোনওদিনও অনুধাবন করার চেষ্টাও করেন নাই, কাছ থেকে না দেখলে কোনদিন বুঝবেনও না। এই অমানুষিক পরিশ্রম আর পড়ালেখা করার যে ব্রত, আর কোন চাকরিতে আছে আমার জানা নাই। তার চরম প্রতিদানই দেন আপনারা। নিদারুণ সম্মান আর ভালোবাসার নমুনা রেখে যান, প্রতিটা পদক্ষেপেই।



এই যে, এই ছবিটা দেখতেছেন, একজন ডাক্তাররে খাইতে দেওয়া হইছে এভাবে। আপনাদের তো অনেক ভাল্লাগতেছে তাই না, এইভাবে খাওন দেওয়া দেইখা? আফটার অল “কসাই” বইলা কথা! খাইতে দিসে এইটাই তো ম্যালা, শোকর গুজার করা উচিৎ। আবার মানসম্মানও চাইয়া বসতে হবে ক্যান? ডাক্তার কি সম্মানের জিনিস? ডাক্তার তো গাইল দেওয়া আর পিটায়া মাইরা ফেলার জাত।
৫ দিন টানা কোভিড ডিউটি করার পরে, চুক্তি অনুযায়ী বগুড়ার ম্যাক্স মোটেলে ডাক্তারদের আইসোলেশনে রাখা হয়। ৪-৫ দিন ওখানে রেখে তারপর ওদের নমুনা সংগ্রহ করে টেস্ট করা হয়। রিপোর্ট নেগেটিভ হলে বাসায় চলে আসবে। তো, আজ ৫ম দিনের ডিউটি শেষে ডাক্তারবাবু সরকার কর্তৃক নির্বাচিত সুন্দর মোটেলে গিয়ে উঠে এভাবে খাবার পেলেন। দরজার সামনে চেয়ারের ভাঙ্গা অংশে খাবারটা এভাবে মাটিতে রেখে গেছে। একটা ছোট টেবিল বা চেয়ারও রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নাই মোটেল কর্তৃপক্ষ।
এইটাই আসল চেহারা বাংলাদেশের। আপনারা এইভাবেই অসম্মানের চোখে দেখেন প্রতিনিয়ত তাদেরকে, যারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জীবনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে প্রতিনিয়ত আপনাদের সেবা করে যাচ্ছে। সরকার থেকে বারবার মানা করার পরেও, ফ্যা ফ্যা করে গায়ে বাতাস লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরেফিরে কোভিড বাঁধিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডাক্তারদের উপরে কুত্তার মতো চিল্লানো পাবলিকগুলাকেও হাসিমুখে চিকিৎসা দিয়ে যেতে হয়। আর তার উত্তম প্রতিদান আপনারা এইভাবে দ্যান। ধন্য রাষ্ট্র, ধন্য দেশ। এম্নে কইরা খাওন যে দিসে, এইটাই তো বিরাট সৌভাগ্য, বাপের আশা পূরণ কইরা ডাক্তার হওয়া প্রজাতন্ত্রের একজন চাকরের তো এইটাই পরম প্রাপ্তি।”