জলবায়ু পরিবর্তন এক অকল্পনীয় সমস্যা হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির হয়েছে। যেহেতু, এটি ছড়িয়ে পড়ছে এজন্য এটি অস্থিতিশীল করতে পারে সারাবিশ্বের অর্থনীতিকে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে এতে দরিদ্র দেশগুলো। কিন্তু, বিশ্ববাসী যত বেশি চিন্তিত করোনাভাইরাস নিয়ে ততটুকু চিন্তিত নন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের কারণে ৪৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন এখন পর্যন্ত। সেখানে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই প্রতিবছর সাত মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। কিন্তু, এই নিয়ে হয় না কোন রুদ্ধদ্বার ও জরুরী বৈঠক। খুব দ্রুতই হয়ত মানুষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারবে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করা যাবে কি? করোনাভাইরাস হচ্ছে একটি আসন্ন বিপদ,পক্ষান্তরে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা অব্যাহতভাবে চলে আসছে।

২০১৮ সালে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬০ মিলিয়ন মানুষ যার মধ্য ইউরোপ, জাপান, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৬০০ এর বেশি। মোজাম্বিক, মালাউ, এবং জিম্বাবুয়েতে সাইক্লোন ইদাই এবং হ্যারিকেন ফ্লোরেন্স ও মাইকেলের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। চার শতাব্দী পূর্বের চেয়ে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলছে ছয়গুন বেশি। যার ফলশ্রুতিতে, বিশ্বের নিম্ন ভূমিগুলো সামনের দিনগুলোতে প্লাবিত হবে। সংক্রামক ব্যাধি এবং জলবায়ু সংকট দুইটি আন্ত:সম্পর্কযুক্ত বিষয়। ফ্রেন্ডস অব দ্যা আর্থের সহকারী নির্বাহী পরিচালক মিরিয়াম টার্নার এইজন্য বলেছেন, “ভবিষ্যতে মানুষ অবাক হবেন যখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনকে করোনাভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করব”।

আমাদের মনে প্রায়শ প্রশ্ন জাগছে, কেন প্রকৃতি আমাদের মানব সভ্যতার প্রতি এখন নিয়তই বিমুখ হচ্ছে? আজ জরুরী হয়ে যাচ্ছে তেমনিভাবে আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কেন জীবাণুরা জেগে উঠছে? এথনোসেন্টিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া দুনিয়ার অপরাপর প্রাণ-প্রজাতির বৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, বাস্তুসংস্থান উল্টে পাল্টে দিচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে নিয়ত প্রাণের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক, ভেঙ্গে যাচ্ছে খাদ্য শৃংঙ্খল ব্যবস্থা। এই পরিবেশগত বিপর্যয়ে একের পর এক জাগছে, নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে নানা রকমের জীবাণু। প্রজাতি হিসেবে মানুষ টিকে থাকার জন্য যা বিপজ্জনক।

অব্যাহতভাবে বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা। গত ১০০ বছরের ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা শুণ্য দশমিক ৮৫ ডিগ্রি বেড়েছে। এ যাবৎকালের ১৪টি উষ্ণতম বছরের মধ্যে ১৩টিই রেকর্ড করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা গ্রীণ হাউজ ইফেক্ট এবং নগরায়ন, শিল্পায়নের কারনে জীব বৈচিত্র্যেরমাত্রা কমছে। দশ হাজার বছর আগে দুনিয়ায় মানুষ ছিল এক ভাগ আর বন্যপ্রাণ ছিল ৯৯ ভাগ। আজ মানুষ হয়েছে ৩২ ভাগ, গবাদি প্রাণিসম্পদ ৬৭ ভাগ আর বন্যপ্রাণ মাত্র একভাগ। পৃথিবীর জুড়ে নির্দয়ভাবে উধাও হচ্ছে বন্য প্রাণের জাত ও পরিসংখ্যান। মানবসভ্যতার এই অনিয়মিত বিকাশই করোনার মত সংক্রামক ব্যাধিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করছে।

যদিও কিছু সমালোচনা বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পর্যায় থেকেও অভিযোগ উঠছে যে, করোনা সংকট চীন ও ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের ফল। ইরানের ‘এলিট বাহিনী’ রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান জেনারেল হোসেন সালামী এমনটি অভিযোগ করেছেন। জীবাণু অস্ত্র মানবসভ্যতার জন্য একধরনের হুমকি। এই হুমকি পারমাণবিক বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ। অপরদিকে, চীন ও ইরানের বিরোধী পক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল অভিযোগের তীর ছুঁড়ছে চীনের উপরই। তারা বলছে, বিশ্বের সবদেশকে জব্দ করতে, চাপে রাখতে সবচেয়ে শক্তিশালী জীবাণু অস্ত্র বানাচ্ছে চীন। কিন্তু, অসাবধানতাবশত তা ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে, সত্যতা যাইহোক না কেন, যদি তা হয়েও থাকে তাহলে তা কিন্তু গর্হিত কাজ। কেননা, ১৯৭২ সালের বায়োলজিক্যাল উয়েপনস কনভেনশন চুক্তি অনুযায়ী জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহার ও প্রসার ঘটানো কিন্তু সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ১৯৭৫ সালে এবং চীন স্বাক্ষর করেছে ১৯৮৪ সালে। যুগে যুগে এই জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে। ১৯১৬ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার যোদ্ধারা ইম্পিরিয়াল রাশিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে ফিনল্যান্ডে অ্যানথাক্সের জীবাণু ব্যবহার করে। ১৯৭৬-৮১ সালে ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছিলেন যে, এই সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যে পাঁচ লাখ মানুষ কিউবায় মারা যায় তা মার্কিন বায়োলজিক্যাল অ্যাটাকের ফল। ১৯৯৩ সালের জুনে জাপানে অম শিনরিকিও নামের একটি সংগঠন অ্যানথাক্স জীবাণু ছড়িয়ে হামলা করেছিল।

তবে, আশা থাকুক করোনাইভারাস এই রকম কোন নোংরা যড়যন্ত্রের ফল নয়। কেননা, এই ধরনের ধ্বংসাত্বক নোংরা যড়যন্ত্র বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টকর হতে পারে। তবে, করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রকৃতির বিরূপ আচরণ বা জীবাণু অস্ত্রের যড়যন্ত্রসহ যে কারণে জন্যই ঘটুক না কেন, এখন তার আশু প্রতিরোধ দরকার। কারণ, সারাবিশ্বের জীবনযাপন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতিসহ সকল কিছুই এখন স্থবির হবার পথে এই নতুন আতঙ্কের জন্য। যতক্ষণ না তার প্রতিষেধক না বের হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সচেতন ভূমিকায় পারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে।


লেখক:- মোঃ হাসান তারেক,
প্রভাষক,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা