শাপলা চত্বরে অগ্রণী ব্যাংকের সামনে হিংস্র পশুর মত ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বুধবার সকালে “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই” ব্যানার ও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলতে এসেছিল ওরা, যেন একাত্তরের সেই ছাত্রসংঘের নরপিশাচের দল! রুখে দাঁড়িয়েছিলেন স্বল্পশিক্ষিত একটা লোক, অভিজাত সমাজের চোখে নীচুতলার একজন মানুষ, মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে লিফটম্যান হিসেবে কর্মরত ৪৫ বছর বয়সী জাফর মুন্সী।
ফলাফলটা হয়েছিল ভয়াবহ। লোহার রড দিয়ে মারতে মারতে জাফর মুন্সীর মাথা থেঁতলে দিয়েছিল ওরা, তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে গিয়েছিল পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথের সামনে। মারার সময় এই ছাত্রসংঘের কর্মীরা যেন সেই একাত্তরের মত বলছিল, “মুক্তিবাহিনীর রক্ত চাই। জাগরণ মঞ্চে সংহতি জানানোর পরিণতি কী, দেখ এবার।”
না, ওরা একাত্তরের ছাত্রসংঘ না। স্রেফ নামটা বদলানো ২০১৩ সালের ছাত্রসংঘ। যাদের আজ সবাই ভদ্র-সভ্য-অমায়িক ছাত্রশিবির হিসেবে চেনে, ইসলামের একমাত্র সহীশুদ্ধ সৈনিকদল হিসেবে অনেকেই মান…
সেদিন শুধু মতিঝিল না, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে একযোগে তাণ্ডব চালায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আলবদরের দল জামাত-শিবির। তাদের নৃশংসতায় গুরুতর আহত জাফর মুন্সীকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যালে এবং পরে ধানমণ্ডির গ্রীণ লাইফ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই ১৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার সকাল দশটার দিকে মুন্সীর মৃত্যু হয়। জামাত-শিবিরের নারকীয় সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আরও একটি নাম। শিবিরের পৈশাচিক আক্রমণে জীবন দিয়ে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবীতে লাগানো সেই ব্যানার-পোস্টার রক্ষা করে গিয়েছিলেন জাফর মুন্সী, অক্ষতই ছিল সেগুলো…



ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাধরদী গ্রামের খোরশেদ আলীর ছেলে জাফর মুন্সী থাকতেন কমলাপুর এলাকার একটি মেসে। তাঁর স্ত্রীর নাম জুলিয়া বেগম। যুবরাজ ও জিসান নামে তাঁর দুই ছেলে এবং জেবা নামে একটি মেয়ে রয়েছে। এই মানুষগুলো সেদিন তাদের হারিয়েছিল তাদের প্রিয় আপনজনকে। এই মানুষগুলো আজো বিচার পায়নি…
মজার ব্যাপারটা হচ্ছে তার বিচারটা দাবী করতে হলে আগে তাকে চিনতে হবে, জানতে হবে, মনে রাখতে হবে। জাফর মুন্সীকে বেশিরভাগ মানুষই চেনে না, জানে না যে তিনি তার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন শিবিরের হাতে, যারা তাকে চেনে না, নামও জানেনি কোনদিন, তাদের যারা জানাতে পারতেন, খুব সহজেই তারা ভুলে গেছেন শহীদ জাফর মুন্সীর কথা। এমনকি শ্রমিকলীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামীলীগও তাকে ভুলে গেছে নিদারুণ অবহেলায়। সবাই জাফর মুন্সীকে এমনভাবেই ভুলেছেন যে বছরে এই একটা দিনেও তাকে নিয়ে তেমন কথা হয় না, গুগলে খুঁজে তার ভালো কোন ছবি, বিস্তারিত কোন লেখা, কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আসাদ কিংবা ১৯৮৭ সালের শহীদ নূর হোসেন অন্তত এ জায়গায় নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। বছরের একটা দিন তো অন্তত তাদের স্মরণ করা হয়, শহীদ জাফর মুন্সীর মত বিস্মৃতির অতলে তো তারা হারিয়ে যাননি…
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে…