আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- একুশের রাতে গাইতেই হবে প্রভাত ফেরির গান। মানুষ গাইবে। সেই সুরেই অনুরনিত হবেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। কালজয়ী এই গানের অমর সুরকার। হারমনিয়ামে যেভাবে প্রতিটি রিডে আঙুল বুলিয়েছিলেন, হামিং করেছিলেন, সেই মুহূর্তটা হুবহু উঠে আসবে বাঙালীর মুখে। ভাষার লড়াইয়ের এমন এলিজি আর হয়নি গোটা ভুবনে।
আলতাফ মাহমুদের আত্মা এভাবেই প্রাণ প্রায় প্রতি একুশে। অথচ কতোভাবেই না মোছার চেষ্টা মানুষটাকে বাংলার ইতিহাস থেকে। কদিন আগেই লোকজনকে দেখলাম মরিয়া লড়ছে তার নামে নাম প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক স্কুলকে বাঁচাতে। এর চেয়ে কঠিন এবং অবাক করা তথ্য জানলাম কয়দিন আগে। আলতাফ মাহমুদের নাম মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ তালিকায় নেই! এই মানুষটার অস্তিত্বই যেন ছিলো না কোনোকালে।
মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বেপরোয়া লড়াইটা লড়েছেন কারা? আমি বলবো ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা। ঢাকার বুকে একের পর এক বোমা ফাটিয়ে, স্থাপনা উড়িয়ে, চেক পয়েন্টে গুলি চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তারা। সুবাদেই অবরুদ্ধ রাজধানীর মানুষ আশায় বুক বাধছিলেন, স্বস্তি পাচ্ছিলেন এই ভেবে যে লড়াইটা মোটেও একতরফা হচ্ছে না। বাঙালী লড়ছে, ক্ষুদিরামরা বোমা ফাটাচ্ছে, পাঞ্জাবিদের মারছে। মুক্তির যুদ্ধ চলছে, জয় আসবেই।
সেই যোদ্ধা দলের সেফ হাউজটা ছিলো শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাসায়। অস্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে শত্রুপক্ষের ইনটেল, পরবর্তী অপারেশনের প্ল্যানিং, নতুন গেরিলাদের আবাসন- সব কিছুর দায়িত্ব ছিলো তার ওপর। সেনাপতিদের যুদ্ধে যাওয়া জরুরী নয়। আলতাফ মাহমুদ বোমা ফাটাননি কিংবা স্টেন হাতে গুলি ছোড়েননি মানেই এই নয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, ক্র্যাক প্লাটুনের কেউ নন। বরং গ্রেফতার একজনের বিশ্বাসঘাতকতায় যখন রুমি-আজাদ-বদি-কামালসহ পুরো গ্রুপটাই ধরা পড়লো, তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীরা তাকে নন ফাইটার বলে রেয়াত করেনি। নাটের গুরু হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিয়েছে।
আপনি আমি তারে তুচ্ছ করি, পাকিস্তানীরা করেনি। তাই নির্মম অত্যাচার তাকেই সইতে হয়েছে বেশী। নামটা তো পুরানো কালার। একুশের গানের সুরকার। অসহযোগ আন্দোলনের সময় হারমনিয়ামে গামছা বেধে গলায় ঝুলিয়ে রাস্তায় গণমানুষের গান গেয়ে যাওয়া বেপরোয়া শিল্পী। অভিযোগ কম নাকি? তারপর একরাতে বাকিদের সঙ্গে চিহ্ন না রেখে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় ক্র্যাক প্লাটুনের সেই যোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের এই ভয়ানক উদাসীন ধৃষ্টতায় আমার কেবল জানতে ইচ্ছা করে- এরা কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? এরা কি শহীদ হননি? পাকিস্তান সরকারের খাতায় এরা ক্রিমিনাল, দুষ্কৃতিকারী। বাংলাদেশ সরকারও কি তাই ভাবেন?
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি একবার তার কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটার সুরকারের কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছিলো আবদুল লতিফকে। জনমানুষ রুখে দাড়ানোয় তা পাত পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম বড় হয়েছে প্রভাত ফেরিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গেয়ে। এই গানের সঙ্গে খালি পায়ে হেটে শহীদ মিনারে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শাওনরে দেখি খুব হতাশ থাকে বাবার এই অবমাননায়, ওর কষ্টটা বুঝতে পারি, বেদনা তীব্রতর হয়। এটা কাভার গানের যুগ, আসল শিল্পীরে চেনে না কেউ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ লড়াইকালের যোদ্ধাদের এইভাবে হাওয়া করে দিয়ে কি প্রতিষ্ঠা পাবে!
ইতিহাস থেকে তাড়ানো যাবে আলতাফ মাহমুদকে? মুছে দেয়া যাবে তার নাম? ওই একটা গানেই যে আবার তিনি অশরীরি কায়ায় বিস্তার নেন গোটা বাংলাদেশ জুড়ে! এতোই সোজা?
লিখেছেন- অমি রহমান পিয়াল, ব্লগার ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।